তোমার উপেক্ষা তাকে ঠেলে দিয়েছে চিতার শিখার বাইরে । তার মুখটা পুড়েছে বটে, কিন্তু হাত-পা এখনো ঢের বাকি । পোড়াবেই যদি তবে এতো মায়া কেন? তাকে চিতার ভিতরে নিয়ে এসো, তবেই না সে পুড়বে ! কষ্ট হলে মাটি খুঁড়ে কবরও দিতে পারো । -নির্মলেন্দু গুণ

Wednesday, August 13, 2014

এই খানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।
এখানে ওখানে ঘুরিয়া ফিরিতে ভেবে হইতাম সারা,
সারা বাড়ি ভরি এত সোনা মোর ছড়াইয়া দিল কারা!
সোনালি ঊষার সোনামুখ তার আমার নয়নে ভরি
লাঙল লইয়া খেতে ছুটিলাম গাঁয়ের ও-পথ ধরি।
যাইবার কালে ফিরে ফিরে তারে দেখে লইতাম কত
এ কথা লইয়া ভাবি-সাব মোরে তামাশা করিত শত।
এমনি করিয়া জানি না কখন জীবনের সাথে মিশে
ছোট-খাট তার হাসি ব্যথা মাঝে হারা হয়ে গেনু দিশে।

বাপের বাড়িতে যাইবার কাল কহিত ধরিয়া পা
আমারে দেখিতে যাইও কিন্তু উজান-তলীর গাঁ।
শাপলার হাটে তরমুজ বেচি পয়সা করি দেড়ী,
পুঁতির মালার একছড়া নিতে কখনও হত না দেরি।
দেড় পয়সার তামাক এবং মাজন লইয়া গাঁটে,
সন্ধাবেলায় ছুটে যাইতাম শ্বশুরবাড়ির বাটে!
হেস না হেস না শোন দাদু, সেই তামাক মাজন পেয়ে,
দাদি যে তোমার কত খুশি হত দেখিতিস যদি চেয়ে!
নথ নেড়ে নেড়ে কহিত হাসিয়া, এতদিন পরে এলে,
পথ পানে চেয়ে আমি যে হেথায় কেঁদে মরি আঁখিজলে।
আমারে ছাড়িয়া এত ব্যথা যার কেমন করিয়া হায়,
কবর দেশেতে ঘুমায়ে রয়েছে নিঝঝুম নিরালায়!
হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, আয় খোদা! দয়াময়,
আমার দাদীর তরেতে যেন গো ভেস্ত নসিব হয়। (সংক্ষেপিত)
__________________
জসীম উদ্দীন

Saturday, August 9, 2014

চাই গো আমি তোমারে চাই
তোমায় আমি চাই--
এই কথাটি সদাই মনে
বলতে যেন পাই।
আর যা-কিছু বাসনাতে
ঘুরে বেড়াই দিনে রাতে
মিথ্যা সে-সব মিথ্যা ওগো
তোমায় আমি চাই।

রাত্রি যেমন লুকিয়ে রাখে
আলোর প্রার্থনাই--
তেমনি গভীর মোহের মাঝে
তোমায় আমি চাই।
শান্তিরে ঝড় যখন হানে
শান্তি তবু চায় সে প্রাণে,
তেমনি তোমায় আঘাত করি
তবু তোমায় চাই।

- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শুধু তোমার জন্য
___ নির্মলেন্দু গুণ

কতবার যে আমি তোমাকে স্পর্শ করতে গিয়ে
গুটিয়ে নিয়েছি হাত-সে কথা ঈশ্বর জানেন।
তোমাকে ভালোবাসার কথা বলতে গিয়েও
কতবার যে আমি সে কথা বলিনি
সে কথা আমার ঈশ্বর জানেন।

তোমার হাতের মৃদু কড়ানাড়ার শব্দ শুনে জেগে উঠবার জন্য
দরোজার সঙ্গে চুম্বকের মতো আমি গেঁথে রেখেছিলাম
আমার কর্ণযুগল; তুমি এসে আমাকে ডেকে বলবেঃ
‘এই ওঠো,
আমি, আ…মি…।‘
আর অমি এ-কী শুনলাম
এমন উল্লাসে নিজেকে নিক্ষেপ করবো তোমার উদ্দেশ্যে
কতবার যে এরকম একটি দৃশ্যের কথা আমি মনে মনে
কল্পনা করেছি, সে-কথা আমার ঈশ্বর জানেন।

আমার চুল পেকেছে তোমার জন্য,
আমার গায়ে জ্বর এসেছে তোমার জন্য,
আমার ঈশ্বর জানেন- আমার মৃত্যু হবে তোমার জন্য।
তারপর অনেকদিন পর একদিন তুমিও জানবে,
আমি জন্মেছিলাম তোমার জন্য। শুধু তোমার জন্য।
" কেউ কথা রাখেনি "
— সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর
কাটলো, কেউ কথা রাখেনি।

ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমি তার
আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিল,
শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে।
তারপর কত চন্দ্রভুক অমাবস্যা চলে গেল
কিন্তু সেই বোষ্টুমী আর এল না
পঁচিশ বছর প্রতীক্ষায় আছি।

মামা বাড়ির মাঝি নাদের আলি বলেছিল,
বড় হও দাদাঠাকুর
তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল
দেখাতে নিয়ে যাবো
সেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর খেলা করে!
নাদের আলি, আমি আর কত বড় হবো?
আমার মাথা এই ঘরের ছাদ
ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর
তুমি আমায় তিনপ্রহরের বিল দেখাবে?

একটাও রয়ালগুলি কিনতে পারিনি কখনো
লাঠি-লজেন্স দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লস্কর বাড়ির ছেলেরা
ভিখারীর মতন চৌধুরীদের
গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি ভিতরে রাস-উৎসব
অবিরল রঙ্গের ধারার মধ্যে সুবর্ন
কঙ্কনপরা-পরা ফর্সা রমনীরা কত রকম আমোদে হেসেছে,
আমার দিকে তারা ফিরেও চায়নি!
বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন,
দেখিস, একদিন আমরাও....
বাবা এখন অন্ধ, আমাদের
দেখা হয়নি কিছুই
সেই রয়্যালগুলি, সেই লাঠি-লজেন্স, সেই রাস-উৎসব
আমায় কেউ ফিরিয়ে দেবে না!

বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল
রেখে বরুনা বলেছিল,
যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালোবাসবে
সেদিন আমার বুকেও এ-রকম আতরের গন্ধ হবে!
ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠোয় প্রান নিয়েছি,
দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়
বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টি নীলপদ্ম!
তবুও কথা রাখেনি বরুনা,
এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ
এখনো সে যে-কোনো নারী!

কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর
কাটলো, কেউ কথা রাখে না!
“কেউ কি এখন”
___শামসুর রাহমান

কেউ কি এখন এই অবেলায়
আমার প্রতি বাড়িয়ে দেবে হাত?
আমার স্মৃতির ঝোপেঝাড়ে
হরিণ কাঁদে অন্ধকারে
এখন আমার বুকের ভেতর
শুকনো পাতা, বিষের মতো রাত ।
দ্বিধান্বিত দাঁড়িয়ে আছি
একটি সাঁকোর কাছাকাছি,
চোখ ফেরাতেই দেখি সাঁকো
এক নিমিষে ভাঙলো অকস্মাৎ ।
গৃহে প্রবেশ করবো সুখে?
চৌকাঠে যায় কপাল ঠুকে ।
বাইরে থাকি নত মুখে
নেকড়েগুলো দেখায় তীক্ষ্ন দাঁত ।
অপরাহ্নে ভালোবাসা
চক্ষে নিয়ে গহন ভাষা
গান শোনালো সর্বনাশা,
এই কি তবে মোহন অপঘাত?
কেউ কি এখন এই অবেলায়
আমার প্রতি বাড়িয়ে দেবে হাত?
আমি বৃষ্টি চেয়েছিলাম তোমার জন্য
না, বৃষ্টি তো আমি আমার জন্য চাইনি।
বোকা মেয়ে!
আমি বৃষ্টি চেয়েছিলাম তোমার জন্য।

আকাশের চালুনি ফুটো করে
যখন বৃষ্টি নামবে অঝোর ধারায়--,
তুমি যাবে বাড়ির ছাদে ভিজতে,
আর আমি তখন আমার জানালার আড়াল দিয়ে
প্রাণ ভরে দেখবো তোমার বৃস্টিভেজা মুখ।

আমি দেখবো শ্রাবণধারায় কীভাবে ক্রমশ,
ধীরে- ধীরে,
ভিজতে-ভিজতে-ভিজতে পুড়ে যাচ্ছে তোমার দেহ।

____নির্মলেন্দু গুণ
সুখ মানে একটি জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে
ঝাপিয়ে পড়া,
সুখ মানে ভালোবাসার টাকাগুলো
অচল কোরে দেয়া।
সুখ মানে নারী ফেলে, ফুল ফেলে
আগুনে সমর্পিত হওয়া।
সুখ মানে নির্বিঘ্নে একটি নির্বিকার
সিগারেট ধরানো।

___রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ